উদ্বাস্তু সময় – ৫
জানুয়ারি 21, 2013 এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান
টেস্ট পরীক্ষায় মালেকিনের ফলাফল ভালই হয়। সে হয় প্রথম। সাতশ-র কাছাকাছি নম্বর। খবরটা শুনে মালেকিন খুব খুশী হয়। কিন্তু যার খুশী মুখ দেখার খুব ইচ্ছে হল, তাকে তো স্কুলে পাওয়া গেল না। খবর নিতেই বেরিয়ে আসে, ইংরেজী স্যারেরও বদলি হয়ে গেছে। এ কারণেই আজ স্কুলের দিকে পা মাড়ান নি। ভীষণ এক ব্যথায় কুকড়ে উঠে হৃদয়টা। বেদনায় নীল কি একে বলে? মনে মনে ভাবে সে। আস্তে আস্তে সে ছুটে যায় স্যারের বাসায় দিকে। স্যারের সেই আশংকা যে এত দ্রুত সত্য লাভ করবে, এ ছিল তার কল্পনার বাইরে। তার বুক ফেটে আর্তনাদ উঠে নীরবে, “আমরা কোথায় চলেছি স্যার?” সে আর্তনাদ কোথাও পৌঁছে না। নিজের ভেতরে ধুকড়ে ধুকড়ে মরে। স্যারকে সে বাসাতেই পায়। কেমন যেন চেহারা, অবনত দৃষ্টি। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন স্যার। কোন কথা বলেন না। শেষে এক গভীর শ্বাস ছেড়ে বলেন, “গ্রামের পোলাপাইনরে পড়াইতে চাইছিলাম। পড়াইতে পারলাম না। ঘরের দুয়ারের স্কুল থুইয়া দূরে যাইয়া পড়াইতে হইবো আর কি?” তারপর একটু পরেই বলেন, “তুই এখন যা।” মালেকিন তখন তাড়াহুড়ো করে বলে, “স্যার আমার রেজাল্ট দিছে। আমি ফার্স্ট হইছি।” ইংরেজী স্যার কিছুক্ষণ অন্যমনস্কভাবে মালেকিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন ভাবে। তারপর বলে, “তোরা ভাল করলে তো আমি খুশী। দেখ্ এখন কী হয় দিন দুনিয়ার। আগের মত আর কিছুই নাই রে। যার যার ভালা, তার তার কাছে এখন।” আর কিছু বলেন না স্যার। মালেকিন ভাবে, স্যারও জানি কেমন অন্যরকম হয়ে গেছেন। কেমন যেন দূর দূর, ছাড়া ছাড়া। তাহলে কার কাছে যাবে সে। হেডস্যারের কথা মনে পড়ে। তার রেজাল্টের খবর শুনলে খুব খুশী হতেন। কাছে ডেকে নিয়ে বলতেন, আমি জানি তুমি পারবা। এখন যে সে কাউকে কাছে পাচ্ছে না। প্রচন্ড জিদ চেপে বসে তার মাথায়। স্যারের বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যেমন করেই হোক, ভালভাবে পরীক্ষা শেষ করে সে এর বিহিত দেখে নেবে। কোথা থেকে কি হচ্ছে? কোথাকার পানি কোথায় গড়াচ্ছে? এখন আর সে কোন কিছুতেই মুখ-চোখ ঘুরিয়ে নিতে প্রস্তুত নয়। তাকে বুঝতে হবে। সবকিছুর উত্তর খুঁজতে হবে। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ঘটে যাচ্ছে। উত্তর জানা সত্ত্বেও এই স্যার দু’জন কিছু বলছেন না। আবার কিছু করতেও পারছেন না। সম্ভবতঃ সাংঘাতিক কিছুই। মালেকিন তার গোপন ইচ্ছাটা এই মূহুর্তে নিজের ভেতরে চেপে রাখে।
২১ শে ফেব্রুযারী এসে গেছে। তার সপ্তাহখানেক পরেই জাতীয় নির্বাচন। কেমন এক হুল-স্থুল, হুল-স্থুল অবস্থা। মানুষগুলো সব পাল্টে গেছে। কেউ কাউকে চিনে না। শোনা যাচ্ছে, টাকা নাকি অনেক কিছুই পাল্টে দেয়। সে সাথে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও কামড়াকামড়ি। ইলেকশনের আন্দোলনে কম বেশি সবাই আন্দোলিত। পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারও অসম্ভব এক তীব্রতায় রুপান্তরিত হয়েছে। সামান্যতেই দু’পক্ষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা চরমে উঠছে। পরিচিত মানুষদের এমন যুদ্ধংদেহী ভাব দেখে মালেকিনকে এক ধরণের আতংকগ্রস্থতা চেপে ধরে। কি হতে যাচ্ছে সামনে? শুধু ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে হাঁটি হাঁটি পা পা করে। পরীক্ষার প্রস্তুতিকে সে নিশ্ছিদ্র রেখে যাচ্ছে। কিন্তু একুশে ফেব্রুযারী উদযাপন থেকে তো সে দূরে সরে থাকতে পারে না। ইলেকশানের ডামাঢোলের মাঝেও সে এগিয়ে আসে। স্কুলের নতুন হেড স্যারের সাথে সে দেখা করে। প্রতিবছরের একুশে ফেব্রুযারীর প্রভাত ফেরীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্কুলের শহীদ মিনার নির্মিত হবার পর বিগত বছর তিনেক হতে তা রীতিমত হয়ে আসছে। স্যার আঁতকে উঠেন বিষধর সাপ দেখার মত, ” নাউজুবিল্লাহ এ তুমি কি কও? আমারে পাপের ভাগীদার করতে চাও। তোমাদের হেড স্যার হইয়া তো দেখি আমার ঈমান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। এসব বেদাতি কাজ আমারে করতে কও। মূর্তি পূজা আমি করমু? বাবারে, তোমার যা ভাল মনে হয় করো। আমারে এরই মাঝে ঢুকাইও না।” মালেকিন স্যার-কে একটু বোঝানোর চেষ্টা করে, “স্যার, আমরা তো শুধু শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো ফুল দিয়ে। তাদেরকে স্মরণ করবো। ভাষা শহীদদের অবদানের জন্যই তো আজ আমরা এই স্বাধীন বাংলাদেশ পেলাম। এতে তো খারাপ কিছু দেখি না স্যার।” স্যারের আঁতে ঘা লাগলো। তিনি বলতে শুরু করলেন, “এই দেখো তোমার দাদা, ঔ যে দেখো মসজিদ, তার ইমাম ছিলেন না? তারও দাদা, এই গ্রামের মানুষদের শরিয়তী শিখাইছে। আর তাদের আওলাদ হইয়া তুমি এই বেদাতি, গুনাহ্গারী কাজ করবা? তুমি যদি চাও, এই ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনার জন্য আমি এই মসজিদে দোয়া কালামের ব্যবস্থা করতে পারি। তাদের জন্য দরকার হইলে কাঙ্গালী ভোজও দিতে পারি। তবু বাবা, তুমি এসব কাজ থেকে দূরে না থাকলেও, আমার এই কাজ করতে কইও না। নাউজুবিল্লাহ!
বাড়ি ফিরে এসে অনেকক্ষণ ধরে ঝিম মেরে বসে থেকে মালেকিন। শহীদরা এই পৃথিবীতে নেই। তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা তো পরকালের জন্য। এতে তো আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু বর্তমানের জন্য, মানুষের চেতনাকে শাণিত, সমৃদ্ধ করার জন্য, যে কারণে শহীদরা তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাকে সমুন্নত রাখার জন্য, তাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া ও টিকিয়ে রাখার মাঝেই তো শহীদদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শণ। তারা পরজগতে চলে গিয়েছে, এই ইহজগতে একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে। সে সত্যের শিখাকে প্রজ্জ্বলিত রাখাই তো বর্তমানের দায়িত্ব। আর তা করার জন্যই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে শহীদ মিনারে এসে মিলিত হই। অনেক কাছাকাছি এসে শহীদদের অনুভব করি। তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করি। ফুল দিয়ে তাদের সম্মান জানাই। আবার নতুন কোন অঙ্গীকারে শপথাবদ্ধ হই। শহীদরা এই ইহজগতে আমাদের সত্ত্বা ও অস্তিত্বকে সম্মানের সাথে বাঁচিয়ে রাখতে এক জীবনপণ সংকল্পে ব্রতী হন। ইহজগতের এই বেঁচে থাকাকে সুষম ও কন্টকহীন করতেই শহীদ স্মরণে বাংলাদেশ নামক এই ভূ-খন্ডের মানুষের এই আচার। যে আচার আর কৃষ্টির রয়েছে বহুমাত্রিকতা। এর সাথে পরজগত বা ধর্মের সাথে কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে, তা মালেকিনের কাছে বিস্ময়কর ঠেকে। মালেকিনের পড়াশুনা খুব বেশী নয়। কিন্তু এতটুকু উপলব্ধি তার কাছে কোন কঠিন মনে হয় না। মানুষ যদি তার অন্তরকে উন্মুক্ত রাখে আলো প্রবেশে, তাহলে সে আলোয় সে সহজে আলোকিত হতে পারে। সে তার পূর্ব পুরুষদের প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞতা বোধ করে। তার পূর্ব-পুরুষেরা ধর্মের এত কাছাকাছি ছিল বলেই, আজ সে উন্মুক্তচিত্তেই এই সত্যাসত্য উপলব্ধি করতে পারছে। ধর্মের উদ্দেশ্য যদি মানুষকে আলোকিত করা হয়, সেখানে ধর্মান্ধতা কোন ক্ষেত্রেই সে মেনে নিতে পারে না। সত্যাসত্য উপলব্ধিতে নিজের অন্তরকে উন্মুক্ত রাখাই কি ধর্মের উদ্দেশ্য নয়? নতুবা ধর্মের মাহাত্ম্যই বা কোথায়? মালেকিন সে উপলব্ধিতে নিজের জীবনকে পুরোপরি সংস্কারহীনভাবে উন্মুক্ত রাখতে চায়।
শামান সাত্ত্বিক | ডিসেম্বর ২৩, ২০১১ | ০২:২৩ বিভাগ: গল্প, মুক্তিযুদ্ধ | ট্যাগ: টীনএজ গল্প