উদ্বাস্তু সময় – ২
ডিসেম্বর 25, 2012 এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান
বিজয় ব্যানার
সেদিনের আর কিছু তার মনে পড়ে না। ভোর রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘুম থেকে উঠে মালেকিন ফুপুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার উঠোনের পুরোটা তার চোখে পড়ে না। প্রাকৃতিক কাজ সেরে এসে সে উঠোনের দিকে ভালভাবে তাকায়। বাবা-ভাইকে তার আর চোখে পড়ে না। কোথায় গেল তাদের লাশ। সে উঠোনের মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক করে। কিছু চোখে পড়ে না। অন্ধকার কিছু কমে এলে, সে উঠোনের চারপাশে বেশ কিছু পায়ের ছাপ দেখে। উঠোনে বাবার শরীরের বড় ছাপটাও তার চোখে পড়ে। সিঁড়ির উপরে পড়ে থাকা ভাইয়ের শরীরের ছাপটা তার কাছে তেমন পরিস্কার মনে হয় না। তাদের ভিটেয় বসে থাকা মাকেও তার চোখে পড়ে না। পরবর্তী সময়ে মালেকিন জানতে পারে রাতের আঁধারে তার চাচা ও গ্রামের দু’চারজন শক্ত-সামর্থ্য মানুষ এসে বাবা ভাইয়ের লাশের সদগতি করে। তাদের ও আশে-পাশের গ্রাম তখন রাজাকার-শান্তিবাহিনী ও পাক হানাদারদের কবলে। গ্রামের জোয়ান ও যুবকদের জীবনের কোন নিরাপত্তা সেখানে ছিল না। যে যেখানে পেরেছে লুকিয়ে থেকেছে। আর তাই উপায়ান্তর না দেখে লাশের দাফন-কাফন রাতের আঁধারেই করতে হয়েছে।
দুঃসময় অতিক্রান্ত হলে, মালেকিন পরবর্তীতে আরো কিছু তথ্য লাভ করে। তার বাবা ও ভাইয়ের হত্যা নিছক সম্পত্তি-সম্পর্কিত বিবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। এই গ্রামেরই পল্টু রাজাকারের সাথে বাবার সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল অনেক দিন থেকে। কোর্ট-কাচারী, উকিল-আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। মামলা মোকদ্দমায় কোন সুযোগ সুবিধাই করতে পারেনি মজুমদার পল্টু রাজাকার। আর সুযোগ পেয়েই এই নৃশংস প্রতিশোধ। এসব শুনে আঁতকে উঠে মালেকিন। বুকের মাঝে হাহাকার বাজে তার। সবই হারিয়েছে সে। বাবা, ভাই ……..। আর কিছুই সে ভাবতে পারে না। বুইব্বার কথা ভেবে সব চেয়ে বেশি কষ্ট পায় সে। মন ভেতরে ডুকরে কেঁদে উঠে, “বুইব্বা তুই যে কই!” প্রতিটা দিনকেই তার কেমন মৃত মনে হয়। মাকে আর তার মা মনেই হয় না। মায়ের স্নেহ ভালবাসার কাঙ্গাল মালেকিন, মায়ের মাঝে আর মাতৃত্ব খুঁজে পায় না।
সে কবে যে সে বুইব্বাকে দেখেছে মালেকিন তা মনে করার চেষ্টা করে। বাবা-ভাইয়ের মারা যাবার পর থেকে, তাকে সে কখনো সালোয়ার-কামিজ পরা আর দেখেনি। অথচ কতই হবে তার বয়স তখন। মালেকিন শুনতো নাহার আপা তখন কলেজে যেতো। আর বুইব্বারও নাকি কলেজে যেতে বছর দুই বাকি ছিল। মালেকিন থেকে ১৪/১৫ বছরের বুইব্বা তখন অনেক দূরে সরে গেছে। তাকে সে হাসতে আর দেখেছে বলেও মনে করতে পারে না। ক’দিন-ই বা ছিল সে বাসায়। ওই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পরে, তিন/চারজন যুবক এসে বুইব্বাকে নিয়ে গেছে। মালেকিন এখন এসব বুঝতে পারে। যুদ্ধ শেষে সে ঠিকই বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বাড়িতে তখন কেমন এক অস্বস্থিদায়ক পরিবেশ বিরাজ করছিল। বুইব্বার আশে-পাশে কাউকে আসতে দেখেনি মালেকিন। সে তার কাছে গেলে বুইব্বার কাছে থেকে কোন সাড়া মেলেনি। যুদ্ধ থেকে ফেরত আসে পাশের বাড়ির ইলিয়াস ভাই। বুইব্বাকে সে দেখতে আসে বাড়িতে। বাড়ির ভেতরে অনেকক্ষণ নাকি সে বসে ছিল তার কাছে। শেষে ইলিয়াস ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বুইব্বা বেড়িয়ে আসে। ইলিয়াস ভাইয়ের শার্টের কোণা ধরে ভিটের দাওয়ায় অনেকক্ষণ নীরবে কানতে থাকে। একসময় ইলিয়াস ভাই ছুটে চলে যায়। মাসখানেক পর খবর আসে, ইলিয়াস ভাই তার এক সহযোদ্ধা পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার বোনকে বিয়ে করে রাজধানীর অদূরে সাভার বলে এক এলাকায় বসবাস করছে। সে আর তাদের গ্রামে ফিরে আসেনি। এরপরের একদিন সন্ধ্যার কথা মালেকিনের মনে পড়ে। বুইব্বার বাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়া তখন বন্ধ হয়ে গেছে। এক সন্ধ্যার আঁধারে পুকুর ঘাট থেকে শাড়ি পরা বুইব্বাকে স্নান করে ফিরতে দেখে। সে যেন তখন বৃষ্টিতে ভেজা নেতিয়ে ঝুলে থাকা বাসী কুমড়ো ফুল। ঝরে পড়ার অপেক্ষা। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সাহস বা ইচ্ছে হয় নি মালেকিনের। কেমন এক কান্না তাকে কামড়ে ধরে। “বুইব্বারে কিছু কথা ক, আবার আগের মতো আমার লগে লাগ্, আবার আগের মতো তুই সালোয়ার-কামিজ পর্, আবার আগের মতো হাস্”। আরো অনেক কিছু মনে পড়লো মালেকিনের। কিন্তু কিছুই বলা হলো না তার বুইব্বাকে। পরদিন সকাল হলে জানাজানি হলো, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধের এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একদিন নাহার আপারও বিয়ে হয়ে অন্য গ্রামে চলে গেল। মালেকিন বাড়িতে খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লো। সে বাড়ির কাছের স্কুলে যেতে থাকে। দিন যেতে থাকে, আর ভেতরে ভেতরে কেমন এক প্রতিশোধ স্পৃহা তার মাঝে দানা বাঁধতে থাকে। না সে ফিরে পাবে তার বাবা-ভাই, বুইব্বাকে, না সেই সময়কে, না সেই পল্টু রাজাকারকে। তাদের এলাকা হানাদার মুক্ত হবার পর পল্টু রাজাকারকে গ্রামের মানুষ মেরে ফেলে। গ্রামের মানুষ না বলে মুক্তিযোদ্ধাই বলা উচিত। বিনা অপরাধে যে অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন এই রাজাকার, পাক হানাদার বাহিনীরা করেছে, তাতে গ্রামের বেঁচে থাকা প্রায় সব সক্ষম সবল মানুষরাই এক সময় দল বেঁধে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য হয়েছে। নারীরাও বসে থাকেনি। নেমে পড়েছে চুপি চুপি মুক্ত হওয়ার স্বপ্নে – অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, সময়মত পুরুষ যোদ্ধাদের সহযোগী হয়ে। বড় হতে হতে মালেকিন এসব শুনেছে, বুঝেছে। কিন্তু মনের ছটফটানি তার দূর হয় নি। সে তো নিজ হাতে এখনও কিছু করে উঠতে পারে নি। নীরবে নিভৃতে কেমন এক প্রতিশোধ স্পৃহা তার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।
নিঃসন্তান ফুপুই এখন তার সব। স্কুলের পড়ার খরচ থেকে শুরু করে, বইপত্র, তার কাপড় চোপড় কেনা বা অন্য যে-কোন খরচই ফুপু মিটিয়েছে। কখনও আর্থিক দৈন্যতার মুখোমুখি তাকে হতে হয়নি। তাদের জমি্-জমা দেখাশোনার ব্যাপারটাও ফুপু-ফুপার উপর। আর কোন বিকল্প ছিল না একেবারে। মা হারিয়েছে এই ইহকাল বা সংসারের মায়া। সেখানে ফুপুর উপর নির্ভর করা ছাড়া বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চিন্তা মনে জন্ম না আসাই স্বাভাবিক। বরং ফুপুর ভালবাসা ও আদরের মায়া মালেকিনকে জমি-জমার ব্যাপারে অন্য কোন চিন্তামুখী হতে দেয়নি। মালেকিন ভাবে, পল্টু রাজাকার মারা যাওয়াতে লাভের লাভ হয়েছে একটাই – তাদের জমিগুলোকে নিষ্কন্টক ও নিরাপদভাবে চাষাবাদের সুযোগ মেলা। কিন্তু তার চোখের সামনে পরিবারের প্রতিটি মানুষের পরিণতির ছবি তার মনের যন্ত্রণা ও ব্যথার আগুণে ঘি ঢেলে যেতে থাকে। মাঝে মাঝে সহপাঠি ও সহযোগীদের দিকে সে কৌতূহলী হয়ে তাকায়। কই তাদের মাঝে তো সে সময়ের তেমন কোন অনুভব তার চোখে পড়ে না। চেতনা বাড়ার সাথে সাথে স্কুলের স্বাধীনতা, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সে সবসময় এক অত্যন্ত উদ্দ্যমী কর্মী হয়ে উঠে। তার মনে পড়ে ‘৭১-র পরবর্তী দু’চার বছর কী আদর-ই না সে পেয়েছে এ দিনগুলোতে। স্কুলের হেডস্যার থেকে শুরু করে অন্যসব শিক্ষকরাই তখন তার প্রতি কি রকম সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতো, সে দেখেছে। তার বাবা-ভাইয়ের নাম উচ্চারিত হয়েছে শহীদ সম্ভাষণে। ফুপুর কাছে মালেকিন শুনেছে, তার বাবার ইচ্ছে ছিল তার ভাই সাদেকিনকে বড় এক উকিল-ব্যারিষ্টার বানাবে। তাহলে আর জমি-জমা নিয়ে বাবাকে এত রেশারেশিতে পড়তে হবে না। আবার কোট-কাচারীতে দৌড়াদৌড়ি করে নাস্তানুবাদ হতে হবে না। ভাইজান যে এস্কুলের চৌহদ্দি পেরিয়ে মফস্বল শহরের কলেজে পড়তো, সে মালেকিন জানে। এও জানে, কলেজ ব্ন্ধ হয়ে পড়াতে ভাইজানকে যুদ্ধের সময় মফস্বল শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে। এই ফিরে আসাটাই যে তার কাল হয়েছে। ফেরার দিন দুই কি তিনদিনের মাথায় ভাইজান শহীদ হন। স্কুলের স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র শহীদ সালেকিন আহমেদের স্মৃতিচারণকালে বক্তারা এ কথাটা কয়েকবার বলেন। আরো বলেন, সাদেকিনের পড়াশুনার প্রতি নিদারুন আন্তরিকতা, এই গ্রামের প্রতি ভালবাসা, শিক্ষকদের গুরুজনের মত সম্মান করা, দরিদ্র ছাত্র ও সহপাঠিদের প্রতি সহমর্মী হওয়া এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। ইংরেজি স্যার এও বলেন, গ্রামের দুঃখী-দরিদ্র মানুষের সুচিকিৎসার জন্য সাদেকিন ডাক্তার হতে চেয়েছিল। হেডস্যার সভায় জানালো, এই গ্রামের মুষ্টিমেয় যে কয়জন স্কুলের বেড়া ডিঙ্গিয়ে কলেজ গিয়েছে, সাদেকিন তার মধ্যে অন্যতম। এসব কথা শুনে মালেকিনের বুক গর্ভে ভরে যেত। নিজেকে মনে হতো অন্য জগতের অন্য এক মাপের মানুষ। এসব কথা শুনে তার চোখে পানিও গড়িয়ে পড়তো। সে কখনো ডুকরে বা কখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো। তখন তার আশেপাশে বসা শিক্ষক বা অভিভাবকরা তাকে জড়িয়ে ধরতো।
শামান সাত্ত্বিক | ডিসেম্বর ১৬, ২০১১ | ১৬:৪২ বিভাগ: গল্প, মুক্তিযুদ্ধ | ট্যাগ: টীনএজ গল্প