উদ্বাস্তু সময় – ১
ডিসেম্বর 15, 2012 এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান
[সাধারণতঃ গল্প পুরো শেষ না করে, আমি ব্লগে গল্পের ধারাবাহিকভাবে পোস্ট দেয়া শুরু করি না। এই ক্ষেত্রে এই গল্পটা ব্যতিক্রম। এর কয়েকটা পর্ব শেষ হয়েছে, মানে অনেকখানি লেখা হয়েছিল ২০০৯-এর ডিসেম্বরের শেষ এবং ২০১০-এর জানুয়ারীর প্রথমদিকের এখানকার চিরাচরিত ছুটির সময়ে। তারপর প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে মার্চ অবধি এই গল্পটা শেষ করার চেষ্টা করে আসছি। এখন পর্যন্ত ৬ পর্ব হয়েছে। আর সম্ভবতঃ ৩টি পর্ব শেষ হলে এই গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। হয়তো এটা একটা মুক্তিযুদ্ধের উপর ছোটখাট টিনএজ উপন্যাস হয়ে যেতে পারে। তা না হলে, একটা বড় গল্প।]
মালেকিন। বুঝে উঠতে পারে না, কি ঘটতে যাচ্ছে তার। সেই ‘৭১ তার স্মৃতিতে আবার ভেসে আসে। কত বয়স ছিল তার তখন ৮ কি ১০! গ্রামের ছেলের বয়স কী আর ঠিকমত মনে থাকে। স্কুলে ভর্তির সময়ে শিক্ষক আর গুরুজনে যে বয়স বসিয়ে দেন, সেই তো তার বয়স। সে হিসেবে ৮ বছর। কিন্তু মালেকিনের তা মনে হয় নি, তার অন্য সহপাঠি বা চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে তুলনা করে। মা-কে জিজ্ঞেস করেও তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারে নি মালেকিন। মা কি আর মা আছে? নিজের পৃথিবীটা এক আল্লাহ-র কাছে যেন নিজ হাতে সঁপে দিয়েছেন। নিজের মত করেই আল্লাহ-কে নিয়ে তার পৃথিবী। সুতরাং ইহজাগতিক কোন বিষয়-আশয় বা আন্দোলন তাকে কোন আঁচড় কাটে না। এ জগৎ হলো মিথ্যে দু’দিনের। এ জগতের মায়া থাকতে নেই। মা যে তার সেই সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। মালেকিনের বয়স যত বাড়তে থাকে আর সে মায়ের কাছ থেকে তত দূরে সরে আসে।
সে বিষণ্ণ বীভৎস সময়টা মালেকিনের মনে পড়ে। সে ছোট বেলাতেই বড়শিতে মাছ ধরা তার পছন্দ। তাদের বাড়ী থেকে একটু পেছনে জংলার ভেতর একটা পুকুর। বাড়ীর মেয়েদেরই সেই পুকুরে একটু বেশি আনাগোনা। আরো অল্প বয়সেই মায়ের নেওটা মালেকিন, মার সাথেই খুব ভোরে এই পুকুরে আসতো। ছাই দিয়ে দাঁত ঘষতো বোকার মত ঘাটের পাড়ে দাঁড়িয়ে। মা রাতের এঁটো হাড়ি-পাতিল পরিস্কার করে নিতো। তার একমাত্র বোনটাও সলজ্জ মুখে মালেকিনের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটতো। মাঝে মাঝে মালেকিনকে নকল করে করে দাঁত ঘষার অনুকরণ করতো। বোনটাকে বেশ ভাল লাগলেও, প্রতিদিন সাত সকালে তার এই খুনসুটি মালেকিনের ভাল লাগতো না। পুকুর পারেই সে মাকে বিচার দিতো, “এই মা দেখো না বুইব্বা আমারে ভেংচি মারে।” বোনটা তখন খিল খিল করে হাসতো। এতক্ষণে বোনটা তার হাত মুখ ওজু শেষ করে বুকে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে পুকুর ঘাটে উঠে দাঁড়িয়েছে। বোনের খিল খিল হাসি শুনে মা শুধু বলতো, “এই মাজু, ওর লগে লাগিস না।” বুইব্বা উত্তর করতো, “তোমার পোলাটা এখনও লেদা রই গেছে, মা।” এই বলে মাজু মক্তবে যাবার জন্য ঘাট ছেড়ে উঠে যায়। মাজু বুবুর সাথে মক্তবে যেতে আরো কিছু বোন আসে – রাহেলা, মিতা, মারজান,বিউটি, আলেয়া। এরা কেউ চাচাতো বোন নয়তো পাড়াতো বোন। এরা এলেই মালেকিন একটু দমে যায়। মাথাটা নীচের দিকে হেঁট করে থাকে। কেউ যদি আবার তাকে কিছু বলে। মাঝে মাঝে মালেকিনকে দেখে মিতা বা মারজান মুচকি মুচকি হাসে। তখন হয়তো মালেকিনের ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে কয়লার গুড়া মুখের লালার সাথে গড়িয়ে পড়ছে। মা মালেকিনের হাত টান দিয়ে কুলি করিয়ে মুখ ধুয়ে দেয়।
একটু বড় হলেও মালেকিনের সাত সকালে পুকুরে আসা থেমে যায় না। এতদিনে বড়শীতে মাছ ধরার একটা নেশা তার তৈরি হয়ে গেছে। জ্যাঠার মেয়ে নাহার আপাকে সে সাত সকালেই মুখ ধোয়ার সময়েই বড়শি ফেলে মাছ ধরতে দেখতো। একদিন নাহার আপার কাছে এসে বড়শিতে মাছ ধরতে কৌতূহলী হলো। নাহার আপা তার হাবভাব বুঝে কিভাবে মাছ ধরতে হয় তা শিখিয়ে দেয়। বড়শিটা বাড়িয়ে দেয় মালেকিন কে। বড়শীর টোপ কিভাবে লাগাতে হয়, তাও দেখিয়ে দেয়। মালেকিন ছিপ পুকুরে ফেলে বসে থাকে। নাহার আপাই টের পায় কিছু একটা বড়শীতে আটকা পড়েছে। সে টেনে তুলতে বলে মালেকিনকে। নিজে হাত লাগায়। একটা বড় ট্যাংরা বড়শিতে ধরা পড়ে। নাহার আপা সাবধানে মাছটাকে পিতলের ঘটিতে রাখে। মালেকিন এক ধরণের তীব্র উল্লাসে ভেতরে ভেতরে রোমাঞ্চিত হয়। বড়শিতে মাছ আটকানো খেলায় সে মেতে উঠে – পুঁটি, ট্যাংরা, কখনো কখনো টাকি। আর পায় কে তাকে। সময় পেলেই বড়শি নিয়ে সে পুকুরে ছুটে যায়।
এমনি এক সাত সকালেই বাড়ির ভেতরে হঠাৎ চিৎকার হৈ-চৈ গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায়। হতচকিত মালেকিন কিছু বুঝার আগেই শংকিত নাহার আপা মালেকিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেন সে কোথাও ছুটে যেতে না পায়। মনে হচ্ছিল, যে কোন শব্দকেই নাহার আপার তখন বড় ভয়। মূর্তির মত মিনিট বিশেক ওই অবস্থায় থাকার পর, নাহার আপাই তাকে ছেড়ে দেয়। ভয়ে থরথর নাহার আপার হৃদকম্পনের উঠানামা মালেকিন ঠিকই টের পাচ্ছিল। মৃত্যুপথযাত্রী রোগী থেকে যেমন পুরো পৃথিবী দূরে সরে যায়। বেশ কিছু পর চিৎকার হৈ-চৈ শব্দ সব থেমে গেলে, মালেকিন ধীর ভীরুপায়ে ঘাট ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
নাহার আপার আতংকের কারণ উপলব্ধি করতে তার আর বেগ পেতে হয় নি। বাবাকে বোঝাই যাচ্ছিল, কাজে যেতে তৈরি হয়েছিল। কাঁধের গামছাখানা বুকের রক্তে জবুথুবু হয়ে গেছে। বাবার প্রিয় গাঢ় নীল-মেটে রঙয়ের পাজ্ঞাবীও রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে। মা ভিটের বারান্দায় বসে বাবার মৃত দেহের উপর নিথর চেয়ে আছে। উঠোনে একটু আগাতেই ভাইজানের লাশ চোখে পড়ে মালেকিনের। ভিটে উঠার সিঁড়ির উপর উপুড় হয়ে কাৎ হয়ে পড়ে আছে। ভাইজান কি তাহলে উঠোন হতে ঘরের ভিতর পালাতে যাচ্ছিল? আঁতকে উঠে মালেকিন অন্যপাশ থেকে ভিটেয় উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে। এতক্ষণে সে ভয়াবহ রকমের এক ভয়ের সম্মুখীন হয়। মানুষ মারা যাবার কথা সে শুনেছে। পাশের বাড়ীর দাদীর মৃত্যুতে সে ও বাড়ীতে ভয়ে ভয়েই গিয়েছিল বছর খানেক আগের একদিন। তখন সে জানতো, মানুষ খুব বুড়ো হলেই মারা যায়। শরীরে যখন তার কোন জোর থাকে না। মৃত্যুকে তার মনে হয়েছিল, এক দূর গ্রহ বাসী। সে মানুষের বুড়ো সময় এলেই তাকে তুলে নিয়ে যায়। এখন মৃত্যুকে একটু আগেই পানিতে নিঃশংকচিত্তে ভেসে বেড়ানো মাছের হঠাৎ বড়শীতে আটকা পড়ে ডাঙ্গায় উঠে আসার মতই মনে হলো। কী যে মিহি পর্দার মত বিভাজন এই জীবন ও মৃত্যুর মাঝে। আজও তা ভেবে মালেকিন শিহরে উঠে। আর এ পাড়ের জীবন নামের এই জীবিত মানুষগুলো কী যন্ত্রণা না বয়ে বেড়ায়। কেউ কেউ আবার জীবন্মৃত হয়ে পড়ে। তার মা কি তা নয়? মালেকিন তার বুইব্বাকেও সেভাবে দেখতে চায়নি। যে বুইব্বার প্রতিমূহুর্তের উপস্থিতি তাকে জাগিয়ে রাখতো। বুইব্বার সাথে কোনদিন কোন কিছুতে চটাং চটাং না লেগে গেলে, তার সে দিনটাকে অর্থহীন মনে হতো। সে বুইব্বার কোন সাড়া না পেয়ে মালেকিন প্রাণাবেগহীন মাকে ছেড়ে বাড়ীর ভেতরে ভীরু পায়ে এগিয়ে গেলো। দূর থেকে আধো খোলা দরজা দিয়ে বুইব্বার যে দৃশ্য সে দেখলো, তা দেখার কথা সে কখনো ভাবেনি। তা তার ভাবনার জগতে কখনো উদয় হয়নি। উদয় হওয়ার প্রশ্নই আসে নি। মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে মালেকিন। জীবন্মৃত মা। স্পন্দনহীন। পৃথিবীর কোন কিছুতে তার আর অবিশ্বাস নেই। নরপশুতে রুপান্তরিত হলে নিষিদ্ধ দ্বার বলতে কিছুই থাকে না। সব নিষিদ্ধ দ্বারের চাবি যেন তার হাতে অবলীলায় উঠে আসে। মালেকিন আর কিছু ভেবে উঠতে পারেনি। সে আবার পুকুর ঘাটে ছুটে যায়। সেখানে নাহার আপা নেই। কিন্তু তাদের ধরা মাছগুলো পিতলের ছোট বালতিতে পানির মাঝে কিল বিল করে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছু না ভেবে মালেকিন বালতিতে আধো লাথি মেরে মাছগুলোকে পুকুরে ফেলে দেয়। সে নাহার আপার খোঁজে এদিক সেদিক ছুটে যায়। কিন্তু কোথাও নাহার আপার দেখা মেলে না।
ঝির ঝির করে বৃষ্টির পানি নামে পুকুরে। পুকুর জলে কাঁপন উঠে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ন্ত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মালেকিন ধীর পায়ে উঠোনের দিকে এগিয়ে আসে। উঠোনে এসেই সে একটু থমকে দাঁড়ায়। কে যেন বাবার গা-মাথা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিয়ে গেছে। সে চাটাইয়ের তল থেকে থকথকে রক্ত বৃষ্টির পানির তোড়ে ও ঝামটা খেয়ে মাটির উঠোনময় বিস্তৃতি পাচ্ছে। অনতিদূরে মাটির ভিটের সিঁড়িতে ভাইজানের শরীরের উপরও জায়নামাজ পড়ার আর একটা পাটি বিছানো। ভিটে বেয়ে ভাইয়ার রক্ত ধীর গতিতে চুঁইয়ে পড়তে দেখে মালেকিন ব্যথিত হয়ে উঠে। চোখে পানি এসে পড়ে তার। মা যেন আগের সেই পাথরের মূর্তি। বাতাসে বৃষ্টির ছিঁটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। তার স্নেহমাখা কোমল শাড়িটাকে। কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার। চোখের পাতাও যেন পড়ছে না আর। মালেকিনের উপস্থিতিও তার মাঝে কোন নড়া-চড়া বা সাড়া শব্দের সৃষ্টি করেনি। উঠোনের এক পাশে বাবা ভাইয়ের রক্ত এসে মিশে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে নরম মাটি তা শুষে নিচ্ছে। মালেকিনের উঠোনের সামনের দিকে এগুতে ভয় হচ্ছে। আকাশ আরো কালো হয়ে উঠেছে। কাউকে কাছে না দেখে সে সত্যি সত্যি ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে। তাদের ভিটের উল্টোদিকের ভিটে বাড়ি থেকে সে আরেক গোঙানীর শব্দ শুনতে পায়। কে কানছে সেখানে? ফুপু! ফুপু না? মালেকিন আর দেরী না করে বাবাকে পাশ কাটিয়ে সে বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
শামান সাত্ত্বিক | মার্চ ২৬, ২০১১ | ১৮:৫৪ বিভাগ: গল্প, মুক্তিযুদ্ধ | ট্যাগ: টীনএজ গল্প